কালের কন্ঠ অনলাইন :: কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। সরকারি সেবাদানের বিপরীতে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নিজ হাতে ঘুষ নেওয়া, জনপ্রতিনিধিদের সাথে দুর্ব্যবহার, বিভিন্ন দিবসের নামে বিত্তবানদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায়ের অভিযোগও রয়েছে। এসব ছাড়াও করোনা পরিস্থিতিতে ত্রাণ বিতরণের সময় মাঠে না থাকা এবং বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে অনিয়ম-দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়াসহ অসংখ্য অভিযোগ এনে তাকে অবিলম্বে পেকুয়া থেকে প্রত্যাহারের দাবি জোরালো হয়েছে।
সেইসাথে দুদক বা নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে অভিযোগ উঠা নানা অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি করেছেন খোদ স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের সর্বস্তরের সচেতন নেতাকর্মীরা। অন্যদিকে পেকুয়ার টইটং ইউনিয়নের ত্রাণের ১৫ টন চাল নয়-ছয়ের ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাঈকা সাহাদাতকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও সরব হয়ে পড়েছে।
এদিকে টইটং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও টইটং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহেদুল ইসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৫ টন চাল আত্মসাতের অভিযোগে বুধবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে সাময়িক বহিষ্কার করে। পরবর্তীতে বৃহস্পতিবার কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ টইটং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে তাকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান।
তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে বৃহস্পতিবার বিকালে পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিস সাঈকা সাহাদাত কালের কন্ঠকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ গুলোর একটিও সত্য নয়। আমি কারো সাথে কোন অবৈধ লেনদেনে জড়িত নই। টইটং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ১৫ টন চাল আত্মসাতের একটি মামলা নিয়েই এখন সবাই আমার বিরুদ্ধে ক্ষীপ্ত হয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ইউএনও হিসাবে থাকলেও এতদিন কেন এসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়নি উল্টো প্রশ্ন তার।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আফসারুল আফসার কালের কন্ঠকে বলেন, মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গেলে একজন সরকারি কর্মকর্তারও ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। তবে এসব দেখার জন্য জেলা প্রশাসকসহ যথারীতি কর্তৃপক্ষ রয়েছেন। তাদের নিকট জানালে কর্তৃপক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিবেন।
কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উঠা এসব অভিযোগের অনুসন্ধান করতে গিয়ে কালের কণ্ঠর কাছেও ভুক্তভোগী অনেক ব্যক্তিও এসব অভিযোগ করেছেন এবং তাদের বক্তব্যও সংরক্ষিত আছে। পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা সাহাব উদ্দিন ফরায়েজীর সন্তান মেহেদী হাসান ফরায়েজী কালের কণ্ঠকে বলেন, আমার বাবাকে সন্ত্রাসীরা রাতের আঁধারে নির্মমভাবে খুন করে লাশ ছড়াখালে ফেলে দিয়েছিল। বিষয়টি জানার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে আমাদেরকে বাড়িতে পাঠান এবং খোঁজ-খবর নেন। পরবর্তীতে গণভবনে ডেকে নিয়ে স্বাক্ষাত করেন এবং পরিবারকে নগদ ২০ লক্ষ টাকার সহায়তা প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, পরবর্তীতে তাদের পরিবারের ভরণ-পোষণ চালানোর জন্য জেলা প্রশাসন থেকে একটি বালুমহাল তার নামে ইজারা প্রদান করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি বালু পরিবহনে নিয়োজিত তার একটি ডাম্পার গাড়ি ধরে উপজেলা পরিষদে নিয়ে গিয়ে নগদ ৩ লাখ টাকা দাবি করেন বর্তমান ইউএনও সাঈকা সাহাদাত। পরবর্তীতে অনেক দেন-দরবার করে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে সেই গাড়ি ছাড়িয়ে নিতে হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি। অভিযোগকারী এসব বিষয় স্থানীয় সাংসদ জাফর আলমকে অবহিত করেন বলেও জানান।
পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সরকার সাধারণ জনগণের জন্য ভিজিডি, ভিডিএফসহ জনবান্ধব নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। যাতে জনগণ কোন অবস্থাতেই অভুক্ত না থাকেন। পাশাপাশি যে কোন দুর্যোগেও সরকারীভাবে যথেষ্ট ত্রাণ-সহায়তা চালানো হয়। কিন্তু বর্তমান ইউএনও ক্ষমতার অপব্যবহার করে এসব প্রকল্পের বিপরীতে স্ব স্ব ইউনিয়নে বরাদ্দ থেকে একটি অংশ কেটে রাখেন এবং সরাসরি চেয়ারম্যান এবং সচিবদেরকেও বাধ্য করেন। এসবের প্রতিবাদ করলে জনপ্রতিনিধিদের সাথেও তিনি চরম দুর্ব্যবহার করেন।
পেকুয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান উম্মে কুলসুম মিনু বলেন, আমিও একজন নারী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছেন। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ আজ বিশ্ববাসীর কাছে রোলমডেল। কিন্তু আমাদের ইউএনও একজন নারী হয়েও মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন। তিনি কথায় কথায় বলে থাকেন, ইউএনও-ই সর্বেসর্বা। এখানে কিসের উপজেলা পরিষদ ? তিনি উপজেলা পরিষদ মানেন না।
পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম কালের কণ্ঠকে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের বিপরীতে কোন ব্যক্তির কাছ থেকে এক টাকাও আদায় না করার জন্য সরকারী এবং দলের পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই নির্দেশনা না মেনে একজন ইউএনও হয়ে এই নারী ফোন করে অফিসে ডেকে নিয়ে অসংখ্য বিত্তবান ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়েছেন।
এসব ব্যাপারে কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলমের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, দলের এবং পেকুয়ার অসংখ্য ব্যক্তি আমাকে ফোন করে প্রতিনিয়ত টাকা দাবি করাসহ ইউএনও’র বিরুদ্ধে নানা ধরণের অভিযোগ উত্থাপন করে আসছেন। বিষয়টি নিয়ে তাকে (ইউএনও) বার বার সতর্ক করে দিয়ে আমি নিজেই বলেছি, আপনার যদি টাকা লাগে তাহলে, প্রতিমাসে আমিই আপনাকে ৫০ হাজার বা ১ লাখ টাকা করে দেব। এরপরও এলাকার কোন মানুষের কাছ থেকে আপনি টাকা চাইবেন না। এরপরও তিনি কোন কর্ণপাত না করায় বিষয়টি সাবেক বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান এবং জেলা প্রশাসকেও একাধিকবার অবহিত করা হয় বলেও জানান তিনি।
পাঠকের মতামত: